রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

ইলেকশনের পর দেশে গণতন্ত্রের ‘গ’ও থাকবে না : শাহ্দীন মালিকের আশঙ্কা

আসিফ আরসালান

এই লেখাটি যেদিন প্রকাশিত হবে সেদিন অর্থাৎ আজ ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের দ্বাদশ নির্বাচন। যদিও এই নির্বাচন নিয়ে ইতোমধ্যেই অনেক কথা হয়েছে তবুও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন তো হয়েই যাচ্ছে। বলতে গেলে সকলেই বলছেন যে এটা কোনো নির্বাচনই নয়, ভোটের রেজাল্ট আগে থেকেই জানা। আসলে এখন শুধু ঠিক করতে হবে পার্লামেন্টে অপজিশনে থাকবে কারা। এটা ছাড়া ভোটের আর কিছু জানার ব্যাপারে কেউ আগ্রহী নন। তারপরেও তো ইলেকশনটি হয়ে যাচ্ছে। কত কথাই তো বিগত দেড় মাস ধরে হলো। 

বলা হলো, আমরা আর মামুদের নির্বাচন এটা। যাহা বাহান্ন, তাহাই তেপ্পান্ন। যার নাম চাল ভাজা তার নামই মুড়ি ভাজা। এগুলো অনেক দিন আগের গ্রামের প্রবাদ। এগুলো এখন ইলেকশনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে। তাই বলছিলাম, আজকের ইলেকশন নিয়ে আর কী লিখবো? 

আপনারা যখন এই লেখাটি পড়বেন ততক্ষণে ভোট দেওয়া শুরু হয়েছে (ভোটের পার্সেন্টেজ যাই হোক না কেন)। আজ সন্ধ্যার পরে রেজাল্ট পাওয়া যাবে (যদিও ফলাফল আগে থেকেই ঠিক করা আছে)। বৈধ হোক আর অবৈধ হোক, নৈতিক হোক আর অনৈতিক হোক, শেখ হাসিনা ১৫ বছর পর লাগাতার চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় যাচ্ছেন। এই মেয়াদ পূর্ণ হলে তিনি লাগাতার শাসন করবেন ২০ বছর। আর প্রথমবারের হিসেব ধরলে মোট ২৫ বছর। আপনি মানুন আর নাই মানুন, ২০১৪ আর ২০১৮ সালের নির্বাচন যে রকম তাজ্জবেরই হোক না কেন, ক্ষমতার মেয়াদের দিক দিয়ে শেখ হাসিনা বিশে^র দুই লৌহ মানবী ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এবং ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকেও টপকে গেলেন। 

এই নির্বাচন নিয়ে দেশে এবং বিদেশে অনেক কথা হচ্ছে। আমরা, আপনারা সকলেই সে কথা জানি। কিন্তু এই ইলেকশনে যে নীতি নৈতিকতা এবং আদর্শ ও মূল্যবোধকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দেওয়া হয়েছে সেটি যে এত নগ্নভাবে প্রকাশিত হবে সেটা সেন্সিবল কোনো মানুষ ভাবতেও পারেননি। টাকা পয়সার জন্য জাতীয় পার্টি যে এত নীচে নামতে পারে সেটি কোনো বিবেকবান মানুষের কল্পনাতেও আসে না। কিন্তু ঐ যে মাঝে মাঝে বলা হয়, কতগুলো সত্য এমন নির্মম যে সেগুলো বাস্তবকেও হার মানায়। সেই নির্লজ্জতা এখন আর গোপন নেই। দৈনিক পত্র-পত্রিকাতেও সেগুলো ফলাও করে ছাপা হচ্ছে। তেমনি জাতীয় পার্টির কিছু কলঙ্কিত ঘটনা বলছি। 

॥ দুই ॥

গত ৩ জানুয়ারি বুধবার দৈনিক সমকালে জাতীয় পার্টির ওপর ৪ কলামব্যাপী একটি বিশাল রিপোর্ট পত্রিকাটির প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে। শিরোনাম, “ভোটের টাকা না পেয়ে সরে পড়ছেন জাপার প্রার্থীরা”। খবরটি বেশ বড়। কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং বলে ঐ খবরটির অধিকাংশই নীচে তুলে দিলাম। 

খবরে বলা হয়ছে, নির্বাচনের মাঠ থেকে একে একে সরে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেওয়া ২৬ আসনের বাইরে থাকা জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থীরা। দুই শতাধিক আসনে দলটির প্রার্থীরা ভোটের লড়াইয়ে নেই। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত তিন দিনে ১৩ আসনে ঘোষণা দিয়ে সরে গেছেন লাঙ্গলের প্রার্থীরা। তাদের অভিযোগ, দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর খোঁজ পাচ্ছেন না। নির্বাচনের মাঠে নামিয়ে খবর নিচ্ছে না দল। নির্বাচন খরচসহ যেসব সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল, তা দিচ্ছে না। 

প্রার্থীদের ভাষ্য, দলের নেতাকর্মীরা নির্বাচন বর্জনের পক্ষে মত দিলেও ‘বিশেষ জায়গা থেকে তহবিল’ পেয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে জাপা। ‘বি ক্যাটেগরি’ আসনের প্রত্যেক প্রার্থীকে ৩০ লাখ এবং ‘সি ক্যাটেগরি’ আসনের প্রার্থীদের ২০ লাখ টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু শীর্ষ নেতারা ওই টাকা নিজেদের পকেটে ঢুকিয়েছেন। তবে জাপা সূত্রের খবর, সেই টাকা পাওয়া যায়নি। সে কারণেই প্রার্থীদের সহায়তা করা যাচ্ছে না।

যাচাই বাছাইয়ের পর মাঠে থাকে জাতীয় পার্টির ২৬৫ জন প্রার্থী। ইতোমধ্যেই এদের মধ্য থেকে অনেক প্রার্থী তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। রিপোর্টটির আরেকটি অংশে বলা হয়, নির্বাচন পরিচালনায় গত ২১ ডিসেম্বর মুজিবুল হক চুন্নুকে আহ্বায়ক করে ১৫ সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করে জাপা। এখন পর্যন্ত কমিটি একজন প্রার্থীকেও নির্বাচনী সহায়তা দেয়নি। কমিটির সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম জহির সমকালকে বলেন, ‘আর্থিকসহ নানা সহযোগিতা চেয়ে প্রার্থীরা যোগাযোগ করছেন। তবে কাউকে আর্থিক সহায়তা করা সম্ভব হয়নি।’

নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সোহরাব হোসেন বলেন, ‘টাকার পাল্লা দেওয়ার অবস্থা আমার নেই। এ ছাড়া দলের চেয়ারম্যান এবং মহাসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, ফোন দিলেও ধরেন না। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও নির্বাচনী কমিটির কেউ সহযোগিতা করছেন না। সরকারের কাছ থেকে ২৬ আসন নিয়েছেন নেতারা। আমাদের সব দিক থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।’ গাজীপুর-৪ আসনের সামসুদ্দিন খান জানান, শারীরিক, পারিবারিক ও আর্থিক সমস্যার কারণে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। সুনামগঞ্জ-১ আসনের আবদুল মান্নান তালুকদার বলেন, ‘নির্বাচন-সংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাড়া পাচ্ছি না, সহযোগিতা পাচ্ছি না। এতে মনে হচ্ছে আসন ভাগাভাগির নির্বাচন হচ্ছে। তাই সরে দাঁড়ালাম।’ হবিগঞ্জ-২ আসনের শংকর পাল বলেন, ‘জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী পরিচয়ে পোস্টার ছাপানোর লোক নই। তাহলে আর জাতীয় পার্টি থাকল কই? আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে সাধারণ মানুষের ভোট পাওয়া যাবে না।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর এবং মহানগর উত্তর জাপার সভাপতি শফিকুল ইসলাম ঢাকা-১৩ ও ১৪ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। তিনি সমকালকে বলেন, ‘২৬ জন ছাড় পেয়ে এমপি হবেন আর বাকিরা জয়ের আশা না থাকলেও টাকা খরচ করবেন, এভাবে নির্বাচন হয় না। জি এম কাদের, মুজিবুল হক চুন্নু এবং দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন।’

আসন ছাড় না পাওয়ায় জয়ের সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে মনে করায় জাপার অনেক প্রার্থী নির্বাচন থেকে নীরবে সরে গেছেন। আর যেসব আসনে জাপার ভোট নেই, সেখানেও প্রার্থীরা প্রচারে নেই। সমঝোতার ২৬ আসনের বাইরে লালমনিরহাট-৩, রংপুর-২, গাইবান্ধা-৪, ঢাকা-১, ঢাকা-৪, নারায়ণগঞ্জ-৩, বরিশাল-৬, সুনামগঞ্জ-৪ আসনে জাতীয় পার্টি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে বলে জানা গেছে। এর বাইরে আরও ১০-১২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না থাকলেও প্রচারে আছে লাঙ্গল।

॥ তিন ॥

নির্বাচন তো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারপর কী হবে? এ ব্যাপারে ঢাকার পত্র পত্রিকাগুলো স্পষ্ট কিছু লেখে না। কিন্তু সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আওয়ামী লীগের রয়েছে বিপুল সংখ্যাধিক্য। তাই মানুষ বাংলাদেশের গণমাধ্যম বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মাধ্যম দেখা ছেড়েই দিয়েছেন। এই অবস্থা দেখে মনে পড়লো ১৯৬৮, ৬৯ ও ৭০ এর কথা। আরো মনে পড়লো ’৭১ এর কথা। তখন বেসরকারি খাতে কোনো টেলিভিশন ছিল না। সরকারি খাতের একমাত্র টেলিভিশন ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন। সেখানেও সরকারের গুনগান ছাড়া আর কোনো খবর থাকতো না। তাই মানুষ বিদেশী গণমাধ্যম বিশেষ করে বিবিসির প্রতি ঝুঁকে পড়ে। এখনও অনেকটা সেরকমই অবস্থা। সরকার সমর্থক অথবা সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের খবরে জনগণের কোনো আস্থা নেই। তবে এবার জনগণ যতটা না বিবিসির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন তার চেয়ে বেশি ঝুঁকে পড়েছেন জার্মান টেলিভিশন চ্যানেল ডয়চে ভ্যালের দিকে। এছাড়া বাংলাদেশে এখন বিশ^বিখ্যাত তিন টেলিভিশন চ্যানেল অর্থাৎ সিএনএন, বিবিসি এবং আল-জাজিরাও দেখা যায়। 

কম খরচে আজকাল আমেরিকা, কানাডা প্রভৃতি দেশে কতিপয় বাংলাদেশী নিজস্ব চ্যানেল খুলেছেন। তারা শুধুমাত্র নিউজ ও ভিউজ সম্প্রচার করেন। এগুলো সাধারণত ইউটিউবে দেখা যায়। মানুষ এখন ঐসব ইউটিউব চ্যানেলও দেখেন। 

॥ চার ॥

তবে আমার ব্যক্তিগত মতে এসব ছোট ছোট প্রাইভেট চ্যানেলগুলোও একপেশে। বিশেষ করে তারা যেসব এক্সক্লুসিভ খবর দেন সেগুলো অধিকাংশ সময়েই সত্য হয় না। তবুও মানুষে ঐসব চ্যানেল দেখেন। এর প্রধান কারণ হলো, ঐসব চ্যানেল অধিকাংশই সরকার বিরোধী। আর বাংলাদেশের মানুষের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখন সরকার বিরোধী। তাই যারাই সরকার বিরোধী খবর দেয় সেগুলোই মানুষ বেশি করে শোনেন। 

তো এসব চ্যানেল বিগত ২ মাস ধরে নানা রকম পলিটিক্যাল প্রেডিকশন বা রাজনৈতিক পূর্বাভাস দিচ্ছে। কিন্তু এগুলোর ৭০ ভাগই সত্য হচ্ছে না। কিন্তু তারপরেও বাকি ৩০ ভাগে এমন কিছু থাকছে যেগুলো মানুষকে খুব আকর্ষণ করছে। এমনকি সপ্তাহ দুয়েক আগেও এমন খবর তারা প্রচার করতেন যা শুনে মনে হতো এই বুঝি দুই চার দিনের মধ্যেই সরকার পড়ে যায় অবস্থা। কিন্তু সরকার পড়ে যায়নি। বরং আরো শক্ত হয়ে গেঁড়ে বসতে যাচ্ছে। 

ভবিষ্যৎ নিয়ে আজ আর বেশি কথা বলবো না। তবে এ ব্যাপারে প্রখ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক শাহ্দীন মালিক অত্যন্ত মূল্যবান কথা বলেছেন। বলেছেন, যেভাবে এবং যে প্যাটার্নে ইলেকশন হতে যাচ্ছে তার ফলে খুব শীঘ্রই আমরা দেখবো যে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ‘গ’ বলে আর কিছু নাই। ড. শাহ্দীন মালিক সকলের নিকট একজন সজ্জন ব্যক্তি বলে পরিচিত। তিনি কোনো দলে নেই। কিন্তু যখন যেটিকে তিনি অকাট্য সত্য বলে জানেন সেটিই বলে ফেলেন। শাহ্দীন মালিকের এই সর্বশেষ মন্তব্য বিরাট আতঙ্কের বিষয় হলেও বিষয়টি উড়িয়ে দেয়ার কিছু নেই। 

কেউ বলছেন ইলেকশনের পর বাংলাদেশ হবে কম্বোডিয়া, কেউ বলেন সিরিয়া, কেউ বলেন উত্তর কোরিয়া আবার কেউ বলেন বেলারুশ। এই চারটি দেশেই গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়েছে। এসেছে ফ্যাসিবাদের চেয়েও নিকৃষ্ট স্বৈরাচার। কেউ কেউ বলেন, অটোক্রেসি, কেউ বলেন প্লুটোক্রেসি, কেউ বলেন অলিগারকি, কেউ বলেন টোটালিটারিয়ানিজম। সবগুলোই ভয়াবহ এবং রক্ত হিম করা রাষ্ট্র ব্যবস্থা। আমাদের কপালে কী আছে সেটি কে জানে?

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ