রবিবার ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

বাবা মায়ের বিচ্ছেদে বিপর্যস্ত শিশুর জীবন

অ্যাডভোকেট তোফাজ্জল বিন আমীন 

বিচ্ছেদ কারো জন্য সুখকর হয় না! হোক তা মৃত্যু কিংবা বিবাহ বিচ্ছেদ। কারণ প্রতিটি সম্পর্কের ছেদ বেদনার হয়। জীবন এলোমেলো করে দেয়। বিশেষ করে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ সন্তানের জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। অথচ এমনটা আমরা কেউ প্রত্যাশা করি না। কিন্তু আমাদের সামাজিক জীবনে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় বাড়ছে। কান পাতলেই সংসার ভাঙার আওয়াজ শোনা যায়। গাঁও-গেরাম থেকে শুরু করে উঁচু তলার বাসিন্দা পর্যন্ত এ ভাঙনের শিকার। এ ভাঙন আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু প্রতিকার মিলছে না।  আমরা সবাই পঙ্গপালের মতো অর্থবিত্তের দিকে ছুটছি। পারিবারিক জীবনের কথা, মানবিকতার কথা ও পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধের কথা আমরা ভুলে যাচ্ছি। ফলে উন্নয়নের তকমাও নিষ্ঠুরতাকে থামাতে পারেনি। বিশেষ করে বাবা-মায়ের সাংসারিক মান-অভিমান ও ক্ষোভ নিষ্পাপ শিশুর জীবনকে না ফেরার দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। খবরে প্রকাশ ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সন্তানসহ হত্যা ও আত্মহত্যার ২৩টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এসব ঘটনা সমাজজীবনে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা বাড়াচ্ছে। কখনো বাবার হাতে সন্তান, কখনো সন্তানের হাতে বাবা-মা নৃশংসতার শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে পারিবারিক কলহের জেরে শিশুর প্রাণ ঝরছে। এ প্রবণতার অবসান হওয়া প্রয়োজন।

আমাদের সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা নতুন না! আগেও ছিল। হয়ত ভবিষ্যতেও থাকবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। নতুবা সামাজিক বন্ধন বিপন্ন হবে। গেল কয়েক বছর ধরে বিবাহ বিচ্ছেদের হার জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রতিদিন গড়ে ৩৭টি পরিবার ভাঙছে। অর্থাৎ প্রতি ৪০ মিনিটে একটি পরিবার ভাঙছে। দুটি জীবনের স্বপ্ন দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। শিশুরা মানসিক যাতনার শিকার হচ্ছে, তা ভুক্তভোগী সন্তান ব্যতিত অন্য কেউ জানে না।  প্রসঙ্গক্রমে ২০১৮ সালের ২৫ জুনের একটি খবরের কথা মনে পড়ে গেল। খবরের শিরোনাম ছিল সন্তানের চোখের পানিতে আদালতে বাবা-মায়ের বন্ধন আবারও একীভূত হলো। ভালোবেসে বিয়ে। সুখের সংসার। সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই ১৩ বছরের সংসারে বিচ্ছেদের সুর বেজে উঠল। বাবা-মা আলাদা হয়ে গেল। সন্তান বাবার কাছে ছিল। মায়ের আদর-সোহাগ থেকে সন্তান বঞ্চিত। ইচ্ছে করলেও মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারতো না। ফলে মা বাধ্য হয়ে আদালতের দারস্থ হন। আদালত মামলার শুনানিকালে দুই শিশুসন্তানের চোখের পানি দেখে উপস্থিত আইনজীবী-বিচারক  সবাই কেঁদেছিল। ফলে সন্তানের চোখের পানিতে ভালোবাসার বন্ধনের জয় হলো। ভালোবাসার বন্ধন একবার ভেঙে গেলে জোড়া লাগানো কঠিন। কিন্তু সন্তানের চোখের পানি বাবা-মায়ের রাগ অভিমানকে নিমিষে বরফ ঢেলে দিল। ফলে ভালোবাসার জয় হলো। দুই সন্তান হাসতে হাসতে মায়ের ঘরে ফিরে গেল। আদালতের মধ্যস্থতায় স্ত্রী তার স্বামীকে, স্বামী তার হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীকে, সন্তান তাদের প্রিয় বাবা-মাকে ফিরে পেল।

বিবাহ বিচ্ছেদ মহামারি আকার ধারণ করেছে। এ রোগের মহামারি থেকে সুরক্ষার জন্য ধর্মীয় ওষুধ ব্যবহারের প্রসার বাড়াতে হবে। নতুবা অমাবশ্যার বিদঘুটে কালো অন্ধকার পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রকে গ্রাস করবে। তখন সেখানে ব্যাভিচারের চাষাবাদ হবে। সুতরাং সাবধান হতেই হবে। বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে কেন এমন প্রশ্ন যে কেউ উত্থাপন করতেই পারেন! এর সাধামাটা উত্তর হচ্ছে- যৌতুক, চাকরি, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, যৌথ পরিবার, বউ শাশুড়ির দ্বন্দ্ব, ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জার, ভাইভার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ডিজিটাল প্লার্টফরমের অবাধ ব্যবহার, ভিনদেশীয় সংস্কৃতি, পরকীয়া, ধৈর্য্যরে অভাব, বহু বিবাহ, মাদকাসক্তি ও অবিশ্বাস দাম্পত্য জীবনে বিচ্ছেদ ঘটায়। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা মানুষের পর্যায়ে পড়ে না। তারা অমানুষে পরিণত হয়। যার স্বামী মাদকাসক্ত সে জানে মাদকের ভয়াবহতা কত নিষ্ঠুর হয়। একজন নারী কখনো তার স্বামীর ভাগ অন্য কাউকে দিতে চায় না। কিন্তু কিছু স্বামী সুন্দরী বধূ ঘরে রেখেও বহু বিবাহ বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে। ফলে সংসারে সন্তান থাকা সত্ত্বেও স্ত্রী বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়। তাছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যখন বিশ্বাসের জায়গাটি নড়বড়ে হয়ে পড়ে তখন সেখানে অবিশ্বাস প্রকট হয়ে উঠে। অথচ সন্দেহ একটি মানসিক রোগ। এ রোগ ডাক্তার সারাতে পারে না। সারাতে পারে না কবিরাজ কিংবা সাধু। সারাতে পারে শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুশাসন ও মূল্যবোধ।

বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য এককভাবে নারী দায়ী নয়! পুরুষও সমভাবে দায়ী। ফলে উভয় পক্ষ থেকেই বিচ্ছেদ হচ্ছে। বিশেষ করে বিয়ের পর নারীর প্রতি এক ধরনের নিপীড়নের খড়গ নেমে আসে। শশুর-শাশুড়ি মনে করে নতুন বউ ঘরে এসেছে, এখন থেকে সকল কাজ সে-ই করবে। কাজের লোকের প্রয়োজন নেই। বউ মানে নতুন কাজের লোক। অথচ নিজের মেয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে দিন পার করে। বাবা-মায়ের ভাষ্য হচ্ছে মেয়ে যদি এখন সুখ না করে তাহলে কবে করবে? সুতরাং বাপের বাড়িতে সুখ করে যাক। অপরদিকে ঘর দুয়ার গোছানো থেকে শুরু করে রান্না করা, আত্মীয় স্বজনদের তোষণ করা, শশুড় শাশুড়ির যতœ নেওয়া, দেবর-ননদের মন জুগিয়ে চলা, হাড়িপাতিল ঘষামাঝা করা এবং স্বামীর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার মহা দায়িত্ব গিয়ে পড়ে স্ত্রীর উপর। এ সমস্ত কাজ করতে গিয়ে গিয়ে যদি একটু উল্টাপাল্টা হয় তাহলে স্ত্রীকে তার খেসারত দিতে হয়। আগেকার দিনের অনেক নারী মুখ বুঝে এ সকল অত্যাচার সহ্য করতো। কারণ তারা স্বাবলম্বী ছিল না। আর যারা অত্যাচার সহ্য করতে পারতো না তাদের কপালে বিচ্ছেদের খড়গ নেমে আসতো। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। এখনকার মেয়েরা স্বাবলম্বী। সুতরাং তারা ঝক্কি-ঝামেলা সহ্য না করে বিচ্ছেদের পথে বাড়ায়।

আমাদের একটা ধর্মীয় মূল্যবোধ তথা সামাজিক মূল্যবোধ ও পারিবারিক  ঐতিহ্য ছিল। অথচ এখন বিবাহ বিচ্ছেদের সিরিজ চলছে। ঘণ্টা নয়, মিনিটে বিচ্ছেদ হচ্ছে। এ বিচ্ছেদ ঠেকানো দরকার। তবে সমাজ বিজ্ঞানীরা এজন্য বিচ্ছিন্নতাবোধকে দায়ী করেছেন। তাছাড়া আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব সর্বসাধারণকে গ্রাস করেছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এর ভাষ্যমতে ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত সাড়ে চার বছরে দুই হাজার ৯১৩টি শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। তার মধ্যে পারিবারিক বলয়ে ৩৮৮টি শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। হত্যার শিকার শিশুদের মধ্যে ৬ বছরের  কম বয়স শিশু রয়েছে ৬৭৬ জন। নয়টি জাতীয় পত্রিকা থেকে তথ্য নিয়ে এবং নিজস্ব প্রক্রিয়ায় তথ্য সঙ্কলিত করে উল্লিখিত তথ্যাদি আসক পরিবেশন করেছে। বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা আগেও ছিল। ভবিষ্যতেও হয়ত থাকবে। কিন্তু পরিসংখ্যান যেভাবে বাড়ছে তা উদ্বেগজনক। বিবাহ বিচ্ছেদের সঠিক পরিসংখ্যান জাতির সামনে উন্মোচন করা প্রয়োজন। এজন্য প্রতিটি বিচ্ছেদের ঘটনা রেকর্ড করার ব্যবস্থা করা দরকার। যেন সমাজের প্রকৃত অবস্থা জানা যায়। 

বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ সন্তানের জীবনকে শুধু একা করে দেয় তা কিন্তু নয়! ভবিষ্যতও অনিশ্চিত করে দেয়, তারা সামাজিক ও মানসিক চাপের মধ্যে বেড়ে উঠে, স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে শিশু তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে বাবা মায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সন্তানের সুন্দর জীবন গড়ার ক্ষেত্রে বাবা মায়ের ভূমিকা অতুলনীয়। অথচ কিছু বাবা-মায়ের রাগ অভিমান-ক্ষোভ-প্রতিশোধ সন্তানের জীবনকে নরকে ঠেলে দেয়। যদিও সন্তানের সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা বাবা-মায়ের দায়িত্ব। সুতরাং সন্তানের কল্যাণে প্রতিটি বাবা-মায়ের উচিত বিচ্ছেদের পথ পরিহার করে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুন্দর ও সুস্থ সমাজ উপহার দেয়া।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ