রবিবার ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

অটিজম ও অস্বাভাবিক শিশু 

চিকিৎসা ব্যবস্থার যতো উন্নতিই হোক না কেন, কোনো না কোনো রোগ সবসময় মানুষের সাধ্যের বাইরে থাকে। সৃষ্টি হয় নতুন নতুন রোগের। অটিজমও তেমন একটি রোগ, যার খবর বাংলাদেশে মাত্র বছর কয়েক আগে জানা গেছে। জানার ক্ষেত্রে বিলম্ব হলেও এই রোগে আক্রান্তরা ছিল আগে থেকেই। সাধারণ মানুষকে অটিজম সম্পর্কে সচেতন করে তোলার উদ্দেশ্যে সম্প্রতি ঢাকায় আয়োজিত একাধিক অনুষ্ঠানে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে অটিজমে আক্রান্ত তথা অটিস্টিক শিশু ও  মানুষের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়ে চলেছে। বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বর্তমানে প্রতি একশ জন শিশুর মধ্যে একজন অটিজমে আক্রান্ত। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগে, ১৯৮০-র দশকেও এই হার ছিল প্রতি আড়াই হাজারে একজন। অবস্থার অবনতি ঘটেছে বিগত কয়েক বছরে। ২০১৪ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিচালিত জরিপে দেখা গিয়েছিল, প্রতি পাঁচশ’জন শিশুর মধ্যে একজন অটিস্টিক। সে হিসাবে দেশে অটিস্টিক শিশুদের সংখ্যা ছিল ৪৩ হাজার। 

কিন্তু ওই পরিসংখ্যানকেও এখন আর সঠিক বলা যাচ্ছে না। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সমাজসেবা অধিদফতর পরিচালিত প্রতিবন্ধী শণাক্তকরণ জরিপ অনুযায়ী দেশে অটিস্টিক শিশুদের সংখ্যা ছিল ৪১ হাজার ৩২৯ জন। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা আরো বেড়ে হয়েছে ৪৪ হাজার ৬৭৫ জন। বড় কথা, সুনির্দিষ্টভাবে সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে বলা সম্ভব না হলেও বাস্তবে অটিজমে আক্রান্তদের সংখ্যা দিন দিন কেবল বেড়েই চলেছে। আশংকার অন্য একটি কারণ হলো, এই সংখ্যা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহর ও নগর এলাকায় অনেক বেশি।  

বলার অপেক্ষা রাখে না, ওপরে সংক্ষেপে উল্লেখিত তথ্য-পরিসংখ্যানগুলো নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ভীতিকর। এমন অবস্থার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চিকিৎসকসহ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শহর ও নগরে বিশেষ করে যৌথ বা বড় পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এবং শিশুদের পিতামাতারা চাকরি ও ব্যবসার জন্য দিনের বেশির ভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকায় শিশুরা ¯েœহ-আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তারা শুধু নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে না, তাদের থাকতে হচ্ছে গৃহপরিচারিকাসহ কাজের লোকজনের কাছে। যথাযথভাবে আদর-যতœ করার পরিবর্তে এসব লোকজনও আবার শিশুদের এখানে-সেখানে বসিয়ে রেখে নিজেদের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। কখনো বা বসিয়ে রাখছে টেলিভিশনের সামনে। পরিবার ছোট রাখার উদ্দেশ্যে এখনকার পিতামাতারা এক বা দু’জনের বেশি সন্তান না নেয়ার ফলেও শিশুরা তাদের বাসায় খেলার কোনো সঙ্গী পাচ্ছে না। এসব কারণে শিশুদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ ঘটতে পারছে না। তারা বরং অটিজমে আক্রান্ত হচ্ছে। 

বিশেষজ্ঞরা কিন্তু আশার কথাও শুনিয়েছেন। তারা বলেছেন, আপতঃদৃষ্টিতে মারাত্মক মনে হলেও অটিজম মোটেই এমন কোনো রোগ নয়, যার চিকিৎসা একেবারে অসম্ভব। মস্তিষ্কের বিভিন্ন ফ্যাকাল্টির প্রাথমিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়াই অটিজম রোগের প্রধান কারণ। মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ ঘটতে পারে না বলেই শিশুরা অটিস্টিক হয়ে ওঠে। এর চিকিৎসাও তাই সহজে সম্ভব, পিতামাতাসহ স্বজনেরা যদি প্রাথমিক পর্যায়েই শিশুর প্রতি লক্ষ্য করতে পারেন। বস্তুত কোনো শিশু যদি স্বাভাবিক অচরণ না করে এবং বাড়ির অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা করার পরিবর্তে একাকী থাকতে বা সময় কাটাতে শুরু করে তখনই বোঝা যায় যে, ওই শিশু অটিজমে আক্রান্ত হয়েছে কিংবা আক্রান্ত হতে চলেছে। অমন অবস্থায় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি শিশুর সঙ্গে বেশি বেশি সময় কাটানো এবং কথা বলা ও আদর করা পিতামাতা এবং বড়োদের দায়িত্ব। এটা করা গেলে অটিজম ওই শিশুকে নাগালে পাবে না বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তারপরও কোনো শিশু যদি আক্রান্ত হয়ে পড়ে তাহলে দেরি না করে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের অনেক হাসপাতালেই এখন অটিস্টিক শিশুদের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। দরকার শুধু সঠিক সময়ে অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটিকে চিহ্নিত করা। আর এ ব্যাপারে প্রধান দায়িত্ব অবশ্যই পিতামাতাসহ অভিভাবকদের।  

সচেতন দায়িত্বশীলরা আমরা মনে করেন, শিশুসহ অটিস্টিক মানুষের চিকিৎসার বিষয়ে কোনো অযতœ বা গাফিলতি করা উচিত নয়। সরকারকে তো এগিয়ে আসতে হবেই, সেই সাথে যতœশীল হতে হবে পিতামাতাসহ আত্মীয়-স্বজনদেরও। বলা দরকার, বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গড় সাধারণ মানুষের তুলনায় অটিস্টিকরা অনেক বেশি প্রতিভাবান। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই তাদের সে প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর এবং প্রতিভাকে কাজে লাগানোর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ