শুক্রবার ০১ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

ডিজিটাল মাইর

মোহাম্মদ লিয়াকত আলী 

ফল্স ফ্রেন্ড গল্পটি এখন আর পাঠ্যপুস্তকে দেখা যায় না। বন্ধু তো বন্ধুই। সে আবার ফল্স হয় কি করে? সে তো ভয়ানক শত্রু। ঘরের শত্রু বিভীষণ। বন্ধুকে ভাল্লুকের মুখে ঠেলে দিয়ে কেটে পড়ে যে, তার চেয়ে বড় শত্রু কে?

 নাদিম ও নাবিলের বন্ধুত্ব এখনো টিকে আছে। বহু দিনের পীড়িত গো বন্ধু সহজে কি যায় ভোলা?

 দুজনই বুদ্ধিমান ফল্স ফ্রেন্ড। একজন আরেক জনকে ঠকানোর ধান্ধায় থাকে সব সময়।  বিকেলে দুজন বেড়াতে বেরিয়েছে শহরের আভিজাত এলাকা বাবর রোডে। 

 একেবারে যেন ঐতিহাসিক মোগল সাম্রাজ্য। আওরঙ্গজেব, নূরজাহান, শেরশাহ, গজনবী তাজমহল সব রাস্তা দখল করে আছে। মোগল সাম্রাজ্যে হাঁটছে, আর ভাবছে, ঠকিয়ে মজা নেয়ার উপায়।

 এপ্রিল ফুলের মতো ঠকানো নয়। মানুষ এখন অবশ্য এপ্রিল ফুলের মুসলিম নিধনের মর্মান্তিক ইতিহাস জেনে গেছে।

 একটি বহুতল শপিং মলের টপ ফ্লোরে ঝলমল করছে নিয়নসাইন। হাইফাই ডিজিটাল হোটেল। এখানে নিজ হাতে কিছু করতে হবে না। সব কাজ করবে রোবট। আপনি শুধু বাটন পুশ করবেন।

-কিছু বুঝলি দোস্ত? 

-রোবটের হাতে গোস্তো না খেলে কিছু বুঝতে পারবি না। চল, আল্লাহর নাম নিয়ে ঢুকে পড়ি।

 কৌতূহল ও কুবুদ্ধি মাথায় নিয়ে দুই বন্ধু উঠে যায় টপ ফ্লোরে।

-ডিজিটাল হোটেলে সুস্বাগতম। উপভোগ করুন ডিজিটাল সেবা।

 সুসজ্জিত এ সি রুমে নরম বালিশ ও গরম বিছানা। পাশে ডিজিটাল ওয়াশরুম।পা বাড়াতেই দরজা খুলে যায়। আগে ঢুকে নাদিম। কানে বাজে ডিজিটাল সাউন্ড। 

-আপনাকে নিজ হাতে কিছু করতে হবে না। একে একে সাতটি বাটনে টাচ করুন। 

 প্রথম বাটন টাচ করতেই রোবট জামা কাপড় খুলে হ্যাঙ্গারে রেখে দেয়। রোবটের চোখ মানুষের মতো নয়। সুতরাং লজ্জার কিছু নেই। দেখাই যাক, এ খেলার শেষ কোথায়।  দ্বিতীয় বাটন চাপতেই কুসুম গরম পানি ঢেলে সারা শরীর ভিজিয়ে নেয়। তৃতীয় বাটনে টাচ করলে সারা শরীরে সুগন্ধি শ্যম্পু মেখে দেয়।  ডেটল সাবান ছাড়াই একশ ভাগ পরিষ্কার গোসল।

চতুর্থ বাটন পুশ করলে রোবট নরম তোয়ালে দিয়ে পানি মুছে দেয়।

  পঞ্চম বাটন খুলে রাখা জামাকাপড় আবার পরিয়ে দেয়। ষষ্ঠ বাটন ফিটফাট শরীরে এয়ার ফ্রেসার স্প্রে করে দেয়। 

 বাকি আর একটি বাটন। ডিজিটাল বডি ওয়াশের ফাইনাল গেমস।  সপ্তম বাটন পুশ করলে ধাক্কা খেয়ে রুম থেকে বাইরে। 

- কিরে দোস্তো, এতোটা সময় বাথরুমে বসে থাকে কেউ?  খুব মজা পেয়েছিস বুঝি? ঘুমাইছিলি নাকি? 

-সাতটি বাটন টেস্ট করতে গিয়ে অনেকটা সময় লস্। এতো বাটন টিপার দরকারই

ছিলো না। তুই ইচ্ছে করলে খুব কম সময়ে সব মজা চেখে নিতে পারবি। এক থেকে তিন পর্যন্ত টিপলেই গোছলের কাম শেষ।

 সাত নাম্বারে ফাইনাল টাচ দিলেই হলো। 

-কোষ্ঠকাঠিন্য রোগীর মতো পেট পরিষ্কার করার অবস্থা আমার নেই। ঝটপট কাজেই আমার আনন্দ। তুই শুধু দেখে যা।

 নাদিম মনে মনে বলে:

-কিযে দেখবো তাতো জানাই আছে। 

 বের হওয়ার আগেই কেটে পড়ে সে।

 বাটন টিপে রোবটের সেবা নেয় আর মনে মনে ফন্দি আঁটে এক মাস আগের ছ্যঁকা খাওয়ার প্রতিশোধ নেয়ার।

 সেদিন প্রচন্ড গরম ছিল। পুকুরে গোছল করতে নেমেছিল দুই বন্ধু।

 নাদিম মেতে থাকে জলকেলিতে। ডুবসাঁতার, মাথা তুলে সাঁতার, মরার মতো ভেসে থাকা, ইত্যাদি কসরতে কেটে যায় অনেকটা সময়।

 জামাকাপড়ের বেগ নিয়ে সটকে পড়ে নাবিল। ভাগ্য ভালো, পরনে বড় সাইজের আন্ডার ওয়ার ছিল। তাই মান ইজ্জত নিয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেছিলো।

  এদিকে ডিজিটাল ওয়াশ রুমে নাবিলের অবস্থা তথৈবচ। ভিজে শরীর মোছা ও জামাকাপড় পরার আগেই সপ্তম বাটন টাচ। সাবান মাখা নগ্ন শরীরটা এক ধাক্কায় ছিটকে পড়ে বাইরে। বাইরে এসে দেখে, বেগও নেই। বিছানার চাদর পেঁচিয়ে চলে আসে রিসিপশনে। 

  -আমার রুমমেট কি চলে গেছে?

 -হ্যা, এই মাত্র ভাড়া মিটিয়ে চলে গেছে। কিন্তু আপনি চাদর নিয়ে কোথায় পালাচ্ছেন?

-পালাচ্ছি না, ইজ্জত বাঁচাচ্ছি। এই চাদর ছাড়া নিচে কিছু নেই। বাড়ি থেকে কাপড় আনাচ্ছি। আপনার সহযোগিতা দরকার। ডিজিটাল শহরের যানজট ঠেলে বাড়ি থেকে কাপড় আসতে এক ঘন্টার ধকল। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে নাদিমের মুন্ডুপাত ছাড়া আর কিছুই করার নেই। এখানে কোন রোবট ও নেই সেবার জন্য।

 বাড়ি থেকে কাপড় আসার পর বাবু সেজে সোজা হয়ে দাঁড়ায় নাবিল। রিসিপশনিস্ট বিদায়ের বাণী শোনায়:

-এক্সিট ডোরের পাশে ডিজিটাল কমেন্ট বুক রয়েছে। মন্তব্য লিখে যান।

- রুমমেট ও কি কমেন্ট করে গেছে?

-অবশ্যই করেছে। ইচ্ছে করলে ব্যাক বাটন টাচ করে পড়ে দেখতে পারেন।

 মজা পেয়ে মজাদার কমেন্ট করেছে ব্যটা:

-ডিজিটাল হোটেলের স্বল্প সময়ের অবস্থান আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত। ওয়াশ রুমের রোবট সেবা অতুলনীয়। এ-ই সিস্টেম সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া দরকার। দেশই এখন ডিজিটাল। অচিরেই পরিণত হবে স্মার্ট বাংলাদেশে। স্থল ও বিমানবন্দর সমূহে বসানো হবে রোবট নিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল ইমিগ্রেশন। রোবটের ধাক্কায় কেউ যাব ইন্ডিয়া, কেউ আমেরিকা, কেউবা রাশিয়া।

 নাবিলকে ও কিছু লিখতে হলো:

-আমার বন্ধু ফল্স হতে পারে। কিন্তু দেশের সাধারণ জনগণ আমার আপনজন। ডিজিটাল হোটেলে সেবার নামে ডিজিটাল প্রতারণা বন্ধ করার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। নইলে ফল্স ফ্রেন্ডে দেশ ভরে যাবে। জনগণ লাথি খেয়ে মরবে। ইতোমধ্যেই সে আলামত শুরু হয়েছে। মজলুম জনতার কান্না শুনে মহান আল্লাহ তো নীরব থাকবেন না। কখনো থাকেননি। যে কোন মুহূর্তে শুরু হতে পারে ডিজিটাল মাইর।  আল্লার মাইর দুনিয়ার বাইর। সেই মাইর হবে সুপার ডিজিটাল। শুধু দুনিয়ার নয়, একেবারে গ্যালাক্সির বাইর। যারা মানুষের কষ্ট দেখে মজা পায়, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে ফূর্তি করে, তাদের দিন ও শেষ হবে। এই দিন দিন নয়, আরো দিন আছে।

 যারা হুমকি দেয়, মাইরের মধ্যে ভাইটামিন আছে, সেই ভাইটামিন নিজেদেরই চাখতে হবে। জাক্কুম ফলের রস আর আগুনে পোড়া মানুষের পুঁজ -রক্ত মিশে ডিজিটাল চাটনি। চাটতে চাটতে গাইবে:

-তেল গেছে ফুরাইয়া, কি হবে আর কান্দিয়া!

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ