গাড়ির জন্য অর্থের অপচয়
সরকারের অর্থ-সম্পদ ব্যবহার ও অপব্যয়ের বিষয়ে বাংলাদেশে এখনও অনেক প্রবাদ এবং গল্প-কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। এসবের মূলকথা হলো, যেহেতু ‘সরকারি মাল’ সেহেতু যতো মূল্যবানই হোক না কেন, কোনো জিনিস ‘দরিয়া’ তথা নদীতে ফেলে দিলেও দোষের কিছু নেই। এ জন্য কারো কাছে কৈফিয়তও দিতে হবে না। এটা যে শুধু কথার কথা নয় তা অনেক উপলক্ষেই প্রমাণিত হয়েছে।
এ বিষয়ে সর্বশেষ প্রমাণ পাওয়া গেছে নতুন গাড়ি কেনার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় সংক্রান্ত খবরে। করোনা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ঘাটতি ও সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে দেশ যখন তীব্র সংকটে রয়েছে এবং সরকার নিজেও যখন ব্যয় কমানোর এবং অপব্যয় বন্ধ করার জন্য তাগিদ দিয়ে চলেছে তেমন এক কঠিন সময়েও খবর বেরিয়েছে যে, ডিসি এবং ইউএনওসহ সরকারি অফিসারদের জন্য গাড়ি কিনতে শত কোটি টাকার অংকে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গতকাল একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে জানানো হয়, নতুন এবং বিলাসবহুল গাড়ি কেনার জন্য সরকার শুধু অনুমতি দেয়নি, ব্যয়ের পরিমাণও অনেক বাড়িয়েছে। ২০১৯ সালে যেখানে একটি গাড়ি কেনার জন্য সর্বোচ্চ ৯৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেয়া হতো সেখানে ২০২৩ সালে বরাদ্দের পরিমাণ করা হয়েছে এক কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ এক ধাপেই বাড়ানো হয়েছে ৫০ লক্ষ টাকা!
‘গাড়িবিলাস’ শিরোনামে প্রকাশিত এই খবরে একই সঙ্গে আরো জানানো হয়েছে, সরকার ডিসি এবং ইউএনওদের জন্য ২৬১টি গাড়ি কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। সেই সাথে ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের জন্য গাড়ি কেনার প্রস্তাবও অনুমোদিত হয়েছে। এসবের পাশাপাশি অন্য এক খবরে বলা হয়েছে, বিভিন্ন দফতরের ৪৩৩ জন প্রকৌশলী তাদের জন্য গাড়ি চেয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছেন। অনেক পুলিশ অফিসারও একই ধরনের বিলাসবহুল গাড়ি পেতে চলেছেন। বিভিন্ন পর্যায়ের যারা গাড়ি চেয়েছেন এবং চাচ্ছেন তারা সুদমুক্ত ঋণের জন্যও আবেদন করেছেন। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অফিসাররা বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। অর্থাৎ শুধু বিলাসবহুল গাড়ি কেনার জন্য অফিসারদের শত কোটি টাকার অংকে সুদমুক্ত ঋণ দেয়া হবে!
আমরা সরকারের এই গাড়ি বিলাসকে সমর্থন করি না। অনেক কারণের মধ্যে বড় একটি কারণ হলো, স্বীকার না করা হলেও বাস্তবে বহুদিন ধরেই সরকার প্রচন্ড অর্থ সংকটে রয়েছে। এই সংকটের কারণে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে যথাসময়ে ভর্তুকি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এরই পাশাপাশি জ্বালানি খাতে ভর্তুকি তুলে নেয়া হয়েছে। ভর্তুকি কমানোর উদ্দেশ্যে দুই দফায় সারের দাম বাড়িয়েছে সরকার। কয়েক দফায় বাড়ানো হয়েছে পানি ও বিদ্যুতের দাম। চিনি ও ভোজ্য তেলের মতো কিছু খাদ্যপণ্যে শুল্কছাড়ের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব নাকচ করেছে সরকার।
এখানেও শেষ নয়। কৃচ্ছসাধনের জন্য চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সরকারি অফিসের জন্য সব ধরনের গাড়ি কেনা বন্ধ থাকবে বলে সিদ্ধান্ত জানিয়ে ২০২০ ও ২০২২ সালের জুলাই মাসে দুটি পরিপত্র জারি করেছিল অর্থ বিভাগ। পরিপত্রে একথাও বলা হয়েছিল যে, ১০ বছরের পুরনো গাড়ি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের অনমোদন নিতে হবে।
অন্যদিকে খরচ কমানোর এবং কৃচ্ছসাধনের সিদ্ধান্তে কোনো পরিবর্তন না করেই সরকার বিলাসবহুল গাড়ি কেনার কার্যক্রম শুরু করেছে। আপত্তি উঠেছে গাড়ির মূল্যের ব্যাপারেও। কারণ, ৯৪ লক্ষ টাকার স্থলে ব্যয় সীমা বাড়িয়ে এক ধাপেই এক কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা করা হয়েছে। সুদমুক্ত ঋণের ব্যাপারেও সরকারের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করার অভিযোগ উঠেছে।
আমরা মনে করি, মুষ্টিমেয় কিছু অফিসারকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করার এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটানোর পরিবর্তে সরকারের উচিত গাড়ি বিলাস প্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসা। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশ এখনও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক পেছনে পড়ে আছে। সেই সাথে রয়েছে ডেঙ্গুসহ অনেক রোগ-বালাই। এসব কারণেও সরকারি অফিসারদের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি দেয়ার কার্যক্রম সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। আমরা তাই গাড়ি কেনার কার্যক্রম বন্ধ করে সাধারণ মানুষের জন্য স্বল্প খরচে ডেঙ্গুসহ সকল রোগ-বালাইয়ের চিকিৎসা দেয়র জন্য তৎপর হওয়ার আহ্বান জানাই।